বর্ষাকালে তাজা ও ভিজা খড় সংরক্ষণ

ভূমিকা
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১.৮-২ কোটি টন ধানের খড় উৎপাদিত হয় । এর মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ উৎপাদিত হয় বর্ষা মৌসুমে ।এ সময়ে বোরো ও আউশ ধান থেকে উৎপাদিত প্রায় ৮০ লক্ষ টন খড় বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা,ও অন্যান্য কারণে শুকানো যায় না , ফলে তা নষ্ট হয়ে যায় । এ পরিমাণ খড়ের বর্তমান বাজারদর কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা । একদিকে এত বিপুল পরিমাণ খড় প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে দেশের গো-খাদ্যেও চাহিদা শতকরা ৪৪ ভাগই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে । তাছাড়া আমন মৌসুমে উৎপাদিত খড়কে শুকাতে কৃষক ভাইদের প্রচুর শ্রম , অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয় । এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ধানের খড়কে কাঁচা ও ভিজা অবস্থায় ইউরিয়া ব্যবহারে সংরক্ষণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে । এই পদ্ধতিতে খড় সংরক্ষণ সবচেয়ে সহজ এবং এর সুবিধাজনক দিক হচ্ছে :
১. ইউরিয়া খড়ের পুষ্টিমান বৃদ্ধি করে,
২. ইউরিয়া সহজলভ্য ও তুলনামূলকভাবে দাম কম,
৩. এই পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ ও নিরাপদ ।
ইউরিয়া ব্যবহারে সংরক্ষণ : সংরক্ষণ পূর্ব প্রস্তুতি
খড়
ধানকাটা ও মাড়ানোর পর কাঁচা ও ভিজা অবস্থায় যে খড় পাওয়া যায় সে অবস্থাতেই খড়কে সংরক্ষণ করা হয় । তবে নিচু পানিবদ্ধ জমি থেকে কেটে আনা খড়ের অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নেয়া উচিত । যে জমির ধান সম্পূর্ণ চিটা হয়ে গেছে তা এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা উচিত নয় ।
খড় সংরক্ষণের স্থান
পানি জমে না এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যুক্ত স্থানে খড়কে সংরক্ষণ করা উচিত । মোটামুটি ৬ ফুট চওড়া এবং ১২ ফুট লম্বা জায়গায় ৫-৬ টন কাঁচা ও ভিজা খড় সংরক্ষণ করা যায় । সাধারণত এ দেশে বৃত্তাকার স্থানের উপর গম্বুজের আকারে খড়ের গাদা তৈরি করা হয় । কিন্তু এ ক্ষেত্রে আনুভূমিক লম্বা খড়ের গাদা তৈরি করতে হবে ।
পলিথিন
বাজারে যে ৮ হাত চওড়া এবং ০.০৮ মিঃ মিঃ পুরো পলিথিন পাওয়া যায় তা সংরক্ষণ কাজের জন্য উপযুক্ত । সাধারণত প্রতি টন ভিজা খড় সংরক্ষণ করতে ৩.৫ থেকে ৪.০ গজ পলিথিন প্রয়োজন হয় ।
ইউরিয়া
খড়ে পানির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে প্রতি একশত কেজি ভিজা খড়ে ১.৫ থেকে ২.০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োজন হয় ।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
# যে স্থানে খড় সংরক্ষণ করা হবে প্রথমে সে স্থানে পুরানো খড়কুটা বা পুরানো পলিথিন বিছাতে হবে ।
# এবার এক স্তর ভিজা যেমন ২ কেজি খড় বিছাতে হবে । উক্ত পরিমাণ খড়ের জন্য ৩৫০-৫০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিতে হবে ।
# এবারে স্তরে স্তরে খড় এবং ইউরিয়া ছিটিয়ে খড়ের গাদা তৈরি করতে হবে । পূর্বেই বলা হয়েছে খড়ের গাদার আকার খাঁড়া গম্বুজাকার না হয়ে চওড়া হবে ।
# যখন সম্পূর্ণ খড় শেষ হবে তখন খড়ের গাদাকে এমন ভাবে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে খড়ের গাদায় কোন বাতাস ঢুকতে বা বের হতে না পারে । পলিথিনের কিনারাগুলো মাটি দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে । অধিক পরিমান খড়ের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যখন খড়ের গাদা চওড়া হয়, সে ক্ষেত্রে দুই টুকরা পলিথিনকে প্রস্থ বরাবর জোড়া (গলিয়ে) দিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে । এ ক্ষেত্রে পলিথিনে যাতে কোনো বড় ধরনের ছিদ্র না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
# অতিরিক্ত পানি যুক্ত খড়ের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে ভিজা স্তরের মাঝে মাঝে এক স্তর শুকনো খড় দিলে খড়ের সংরক্ষণ ভালো হয় ।
# সাধারণত বিভিন্ন জমির ধান সাধারণত বিভিন্ন সময়ে কাটা হয় । এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব এক সাথে সব খড় সংরক্ষণ সবচেয়ে উত্তম ।তবে কিছু পরিমান খড় ইউরিয়া দিয়ে বায়ুরোধী ( অর্থাৎ পলিথিনে ঢাকা ) অবস্থায় সংক্ষণের পর সেখানে নতুন ভিজা খড় যোগ করতে হলে গাদার পলিথিন সরিয়ে কিছু পরিমাণ (৩০০-৫০০ গ্রাম, গাদার আকারের উপর নির্ভর করে ) ইউরিয়া ছিটিয়ে দিতে হবে এবং পরবর্তীতে পূর্বে বর্ণিত নিয়মানুসারে খড় এবং ইউরিয়া দিতে হবে । সব শেষে পূর্বের ন্যায় খড়ের গাদাকে পলিথিন দিয়ে বায়ুরোধী অবস্থায় ঢেকে দিতে হবে ।
সংরক্ষণ কাল
সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত খড় এক বছরের অধিক সময় সংরক্ষণ করা যায় । সংরক্ষণের দুই সপ্তাহ পর থেকে যে কোনো সময় ইচ্ছা করলে এ খড় গাদা থেকে বের করে গরুকে খাওয়ানো যেতে পারে ।
সংরক্ষিত খড় খাওয়ানো :
গাদা থেকে বের করা সংরক্ষিত খড়ে প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়া থাকে । খোলা বাতাসে আধ ঘন্টা পরিমাণ সময় রেখে দিলে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া চলে যায় । এর পর উক্ত সংরক্ষিত খড়কে শুকনো খড় বা কাঁচা ঘাসের সাথে মিশিয়ে গরুকে খাওয়ানো যেতে পারে । গরু সাধারণত সংরক্ষিত খড় পছন্দ করে তাই খাওয়াতে অসুবিধা হয় না । কোনো ক্ষেত্রে গরু তা অপছন্দ করলে আস্তে আস্তে তাকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে । সংরক্ষিত ভিজা খড়কে পুনরায় শুকানোর কোনো প্রয়োজন নেই এবং এতে খড়ের পুষ্টিমান কমে যায় ।
ইউরিয়া ভিজা খড়কে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর পুষ্টিমান ও বৃদ্ধি করে । বাংলাদেশ প্রণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, সংরক্ষিত খড়ের প্রোটিন ,বিপাকীয় শক্তি,পাচ্যতা এবং খাদ্য গ্রহণ শুকানো খড়ের তুলনায় অনেক বেশি (১ নং সারণি দেখুন ) । উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে , সংরক্ষিত খড়ের পুষ্টিমান শুকানো খড়ের তুলনায় ১.৪ গুণ বেশি । অর্থাৎ একই পরিমাণ উৎপাদনের জন্য শুকানো খড়ের তুলনায় সংরক্ষিত ভেজা খড়ে কম খাদ্যের প্রয়োজন ।
সারণি ১ : শুকানো ও ইউরিয়া সংরক্ষিত ভিজা খড়ের তুলনামূলক পুষ্টিমান



সাবধানতা
১. এই সংরক্ষণ পদ্ধতিতে খড়ের গাদায় পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যামোনিয়া থাকা প্রয়োজন । তাই সংরক্ষণকালে পলিথিনের আবরণ যাতে কোনো ভাবে নষ্ট না হয় সে দিকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে ।
২. পূর্বেই বলা হয়েছে যে, যে সব ক্ষেতের ধান পুরোপুরি চিটা হয়ে গেছে সেসব খড় এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা উচিত নয় । কারণ এ ধরনের সংরক্ষিত খড়ে ইমিডেজল জাতীয় যৌগ উৎপাদন হয় যা খেলে গরুর অসুবিধা হতে পারে ।
উপসংহার
উপরোক্ত সংরক্ষরণ পদ্ধতিটি শুধু বর্ষা মৌসুমে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ খড়ের পচন রোধই করে না, বরং খাদ্যমানও বৃদ্ধি করে । তাছাড়া সংরক্ষণ পদ্ধতিটি কৃষকের, শ্রম, সময় এবং আর্থিক সাশ্রয় করবে ।