ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র (ইউ এম এস )

ভূমিকা
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা এ গত ১৯৯২ সাল থেকে দীর্ঘ গবেষণা ও কৃষক পর্যায়ে যাচাই করে দেশে প্রাপ্ত খড়, ইউরিয়া ও চিটাগুড়ের মিশ্রণে ( ৮২:৩:১৫) ইউ এম এস গো-খাদ্য প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করা হয়েছে ।
ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউ এম এস কী ?
এটি ইউরিয়া, মোলাসেস এবং খড় ( স্ট্র) এর একটি মিশ্রিত খাবার যা গরুকে প্রতিদিন শুকনা খড়ের পরিবর্তে চাহিদা মত খাওয়ানো যায় । খাদ্যটিতে খড়, ইউরিয়া ও চিটাগুড় বা মোলাসেসের অনুপাত যথাক্রমে ৮২:৩:১৫ ।
ইউ এম এস কিভাবে তৈরি করা হয়?
# ইউ এম এস তৈরির প্রথম শর্ত হলো এর উপাদানগুলোর অনুপাত সর্বদা সঠিক রাখতে হবে অর্থাৎ ১০০ ভাগ ইউ এম এস এর শুষ্ক পদার্থের মধ্যে ৮২ ভাগ খড়, ১৫ ভাগ মোলাসেস এবং ৩ ভাগ ইউরিয়া থাকতে হবে । এ হিসাব মতে ১০০ কেজি শুকনা খড় , ঘনত্বের উপর নির্ভর করে ২১- ১৪ কেজি মোলাসেস এবং কেজি ইউরিয়া মেশালেই চলবে । খড় ভিজা বা মোলাসেস পাতলা হলে উভয়ের পরিমাণই বাড়িয়ে দিতে হবে ।
# প্রথমে খড় , মোলাসেস ও ইউরিয়ার পরিমাণ মেপে নিতে হবে । বিভিন্ন পরিমাণ খড়ের সাথে ইউরিয়া ও মোলাসেস কী পরিমাণ মেশাতে হবে তার একটি সারণি নিম্নে দেয়া হলো ।
# মোলাসেস ও ইউরিয়া ওজনের পর প্রয়োজন মতো পরিষ্কার পানিতে ( সাধারণত ৪০-৬০ কিলো ) এমন ঘনত্বে মেশাতে হবে যাতে সম্পূর্ণ দ্রবণ খড়ের সাথে সহজে মেশানো যায় । পানি বেশি হলে দ্রবণটুকু খড় চুষে নিতে পারবেনা আবার কম হলে দ্রবণ ছিটানো সমস্যা হবে ।
# শুকনো খড়কে পলিথিন বিছানো বা পাকা মেঝেতে সমভাবে বিছিয়ে ইউরিয়া মোলাসেস দ্রবণটি আস্তে আস্তে ঝরণা বা হাত দিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে , এবং সাথে সাথে খড়কে উল্টিয়ে দিতে হবে যাতে খড় দ্রবণ চুষে নেয় । এভাবে স্তরে স্তরে খড় সাজাতে হবে এবং ইউরিয়া মোলাসেস দ্রবণ সমভাবে মিশিয়ে নিতে হবে । ওজন করা খড়ের সাথে পুরো দ্রবণ মিশিয়ে নিলেই ইউ এম এস পশুকে খাওয়ানোর উপযুক্ত হয় ।
# অন্যভাবেও ইউ এম এস তৈরি করা যায় । এ পদ্ধতিতে যে কোন প্রকার পাত্রে ওজন করা মোলাসেস ও ইউরিয়াতে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে । তারপর সারণিতে উল্লেখিত হিসাব মোতাবেক ওজন করা খড় এমনভাবে ভিজাতে হবে যাতে পুরো দ্রবণটি শুষে নেয় । উক্ত যে কোনো উপায়ে তৈরি ইউরিয়া মোলাসেস খড় সঙ্গে সঙ্গে গরুকে খাওয়ানো যায় অথবা একবারে ২/৩দিনের তৈরি খড় সংরক্ষণ করে আস্তে আস্তে খাওয়ানো যায় । তবে কোনো অবস্থাতেই খড় বানিয়ে তিন দিনের বেশি রাখা উচিত নয় । কারণ তাতে খড়ে ইউরিয়া এবং মোলাসেসের পরিমাণ কমতে থাকবে ।
সারণি : ইউ এম এস প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন উপাদানের আনুপাতিক হার :



ইউ এম এস খাওয়ানোর গবেষণালব্ধ ফল
# বি এল আর আই গবেষণায় দেখা গেছে বাড়ন্ত ষাঁড়কে (৩০০ কিলো) ইউ এম এস যথেস্ট পরিমান খাওয়ানোর সাথে দৈহিক ওজনের শতকরা ০.০৮-১.০ ভাগ দানাদার মিশ্রণ সরবরাহ করলে ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম দৈনিক ওজন বৃদ্ধি পায় ।
# অন্য একটি গবেষনায় দেখা গেছে পাবনা অঞ্চলের গাভীকে শুকনো খড়ের পরিবর্তে ইউ এম এস খাওয়ালে গাভী প্রতি দৈনিক দানাদার খাদ্যের পরিমান ১.৫০ কেজি কম দিয়েও দুধের উৎপাদন প্রায় ১.০ লিটার বেড়ে যায় ।
কেন ইউ এম এস খাওয়ালে গরুর দুধ বা ওজন বৃদ্ধি পায় ?
# গরু রুমেনের প্রয়োজন মোতাবেক আস্তে আস্তে খড়ের সাথে ইউরিয়া থেকে নাইট্রোজেন এবং মোলাসেস থেকে শর্করার সরবরাহ পেয়ে থাকে । শুধু তাই নয় , মোলাসেস একইভাবে খনিজ পদার্থও পশুকে সরবরাহ করে ।
# উক্ত খাদ্য প্রণালী গরুর রুমেনের পরিবেশ সঠিক রাখে । ফলে খড় জাতীয় খাদ্যের পরিপাচ্যতা বৃদ্ধি পায় ।
সুবিধা
# ইউ এম এস বাছুর, বাড়ন্ত, দুগ্ধবর্তী ও গর্ভবতী গরু অথবা মহিষকে তাদের চাহিদা মতো খাওয়ানো যায় ।
# শুধু ইউ এম এস খাওয়ালেও ওজন বৃদ্ধি পায় ।
# ইউ, এম, এস তৈরির পদ্ধতি সহজ ।একজন শ্রমিক অনায়াসে দৈনিক ৫০০-৬০০ কেজি খড় বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে তৈরি করতে পারেন । খড়ের দাম বাদ দিলে ইউরিয়া , মোলাসেস ও শ্রমিক খরচ বাবদ কেজি প্রতি ইউ, এম,এস এর খরচ পড়ে ০.৬৫ হতে ০.৭৫ টাকা ।
মোলাসেস ও শ্রমিকের ওপর এই খরচ নির্ভর করে ।
# গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ পদ্ধতিতে খড়ের সঙ্গে ১.০০ টাকার মোলাসেস খাইয়ে প্রায় ৫.০০ থেকে ৭.০০ টাকা মূল্যেও গরুর মাংস উৎপাদন সম্ভব ।
# ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক চেটে খাওয়ালে প্রাণির যে উপকার হয় তা ইউ এম এস দ্বারাই সম্ভব । উপরন্তু কৃষক কম মূল্যে নিজের বাড়িতেই ইউ এম এস তৈরি করতে পারেন । ব্লক চেটে খাওয়ানোর মতো কোন ঝামেলা এ পদ্ধতিতে নেই ।
# যেহেতু ইউরিয়া ও মোলাসেস খড়ের সাথে ধীরে ধীরে খাচ্ছে, অতএব বিষক্রিয়া হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই ।
# সকল বয়সের গরু ও মহিষ যথেস্ট পরিমাণ এই খাদ্য গ্রহণ করতে পারে ।
# গর্ভবতী পশুও এই খাদ্য খেতে পারে ।
# কৃষক তার দৈনিক চাহিদা অনুযায়ী খড় প্রস্তুত করে প্রতিদিন খাওয়াতে পারেন ।
অসুবিধা
# ইউ এম এস পদ্ধতিতে ইউরিয়া মোলাসেস খাওয়ানোর তেমন কোন অসুবিধা নেই । শুধু মাত্র ইহা তৈরি করে ৩ দিনের বেশি সংরক্ষণ করে রাখা যায় না ।
সাবধনতা
# অবশ্যই ইউ এম এস তৈরির করার সময় ইউরিয়া, মোলাসেস, খড় ও পানির অনুপাত ঠিক রাখতে হবে । ইউরিয়ার মাত্রা কোন অবস্থাতেই বাড়ানো যাবেনা । ইউ এম এস এর গঠন পরিবর্তন করলে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাবে না ।
ইউ এম এস প্রযুক্তি ব্যবহারে গরু মোটাতাজা করণে খাদ্য সূত্র (সূত্র নং -১)
গরুর প্রতিদিনের খাদ্য = ইউ এম এস (গরুর ইচ্ছামতো) +দানাদার মিশ্রণ (ওজনের শতকরা ০.৮-১.০ ভাগ )
ইউ এম এস ব্যবহারে দুগ্ধবর্তী গাভীর খাদ্য সূত্র (সূত্র নং-২)
দৈনিক খাদ্যেও পরিমাণ=ইউ এম এস (গাভীর ইচ্ছামতো) + দুধের উৎপাদনের ভিত্তিতে দানাদার মিশ্রণ ।
ইউ এম এস ব্যবহারে বাছুরের (৬ মাস ) খাদ্য সূত্র (সূত্র নং -৩)
দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ = ইউ এম এস (বাছুরের ইচ্ছামতো ) + দানাদার মিশ্রণ (ওজনের শতকরা ১.০ ভাগ )
দানাদার মিশ্রণ
১. গম,চাল বা ভূট্টা ভাংগা=১০-২০ কেজি
২. গমের ভূষি ও ধানের কুঁড়ার মিশ্রণ (১:১) =৪৫-৫৫ কেজি
৩. সরিষা, তিল বা নারিকেলের খৈল = ২০-২৫ কেজি
৪. মাছের গুড়া = ৪-৫ কেজি
৫. চুনাপাথর বা ঝিনুকের পাউডার = ৩-৪ কেজি
৬. লবণ = ০.৫-১ কেজি
প্রযুক্তিটি সহজ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হীন ও লাভজনক । ইউ এম এস গো-খাদ্য প্রযুক্তিটি গবাদি প্রাণির পুষ্টি সরবরাহ করে এবং একই সাথে গবাদি প্রাণি থেকে পরিবেশ দূষণ হ্রাস করে । দেশের দুধ ও মাংসের ঘাটতি পূরণ ও বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থান করতে বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠায় ইউ এম এস প্রযুক্তিটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি ।